মোঃ মুরাদ হোসেন,স্টাফ রিপোর্টারঃ-শ্রমজীবী মানুষের রক্তাক্ত আন্দোলণের কর্মঘন্টা আদায়ের দিন আজ মহান “মে দিবস”। দিনটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। শ্রমিকের রক্তে ভেজা দিনটি আজ সারা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে একযোগে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত দিবসটি এখন “আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস” হিসেবে পরিচিত। বরাবরই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রমিক সংগঠনগুলো এ দিবসটি উৎসাহ,উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদযাপণ করে থাকে।
সোমবার(১লা মে) সকালে এ উপলক্ষে দেশের বৃহত্তর স্থলবন্দর বেনাপোলে শত সহস্র শ্রমিকের জমায়েতে “শ্রমিক শোভাযাত্রা”বের করা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন বেনাপোল স্থলবন্দরের হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়ন(৯২৫এবং৮৯১) এর নেতা-অহিদুজ্জামান অহিদ,রাজু আহম্মেদ,আক্তারুজ্জামান ও জাহাঙ্গীর আলী জান।
এসময় অন্যান্যদের মধ্যে অংশ নেন-বেনাপোল পোর্টথানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মোঃ কামাল হোসেন ভূঁইয়া,বেনাপোল পৌর আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক-মোঃ নাসির উদ্দিন,বেনাপোল পৌর কাউন্সিলর ও পৌর যুবলীগ আহবায়ক-আহাদুজ্জামান বকুল,পৌর স্বেচ্ছাসেবকলীগ সাধারণ সম্পাদক-মোঃ কামাল হোসেন,দপ্তর সম্পাদক-নাজিম উদ্দিন রাব্বি,সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোঃ কামাল হোসেন(প্রতিষ্ঠাতা, রাসেল স্মৃতি সংঘ,বড় আঁচড়া,৯নং ওয়ার্ড),শ্রমিক নেতা-নাসির মল্লিক সহ প্রমূখ।
“দুনিয়ার মজদুর এক হও,এক হও”। “প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার অক্ষুন্ন থাকুক,দুরহউক সকল বৈষম্য,মেহনতি মানুষের পাশে আছি,সুস্থ শ্রমিক,উন্নত দেশ গড়বো মোরা বাংলাদেশ”—– এমন সব শ্লোগান বেষ্টিত ব্যানার নিয়ে “শ্রমিক শোভাযাত্রা”টি বন্দর সংলগ্ন শ্রমিক কার্যালয় থেকে শুরু করে বেনাপোলের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সমূহে প্রদক্ষিন শেষে পুণরায় শ্রমিক কার্যালয় এসে শেষ হয়। এরপর সেখানে মহান মে দিবস তথা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের ইতিহাস পর্যালোচনায় সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
শ্রমিক অধিকার আদায় করতে গিয়ে দেশে এবং বিদেশে এ পর্যন্ত যতজন শ্রমিক প্রাণ বিষর্জন দিয়েছেন এবং যারা আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপণ করে সমাবেশে বক্তারা বলেন, “রক্তাক্ত এক ইতিহাসের সাক্ষী “মে দিবস”। দীর্ঘদিনের অমানুষিক পরিশ্রম আর কম পারিশ্রমিক পাওয়া শ্রমিকরা সেদিন রক্তের বিনিময়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে মালিক পক্ষের উপর গর্জে উঠেছিল। শ্রমিকদের দাবি ছিল, ‘৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম আর ৮ ঘণ্টা নিজের জন্য’। তারা প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় কাজ করত কর্তৃপক্ষের নির্দেশে।
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিক আন্দোলনই মহান মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস নামে পরিচিত। দিবসটি শ্রমজীবী মানুষকে সব ধরনের অন্যায় আর অমানবিকতার বিপক্ষে গর্জে ওঠার পথ দেখায়”।
উল্লেখ্য, ইতিহাসের পাতা থেকে “মে দিবস” সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়,”আমেরিকার শিকাগো শহর তখন শিল্পায়নের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিতি ছিল, আমেরিকান শ্রমিকরা ছাড়াও পৃথিবী’র অন্যান্য দেশের শ্রমিকগণ কাজের খোঁজে ঐ শিল্পনগরী শিকাগোতে যেতো, মাত্র দেড় ডলারের বিনিময়ে তারা দিন-রাত সপ্তাহে ৬দিন কলুর বলদের মতো শ্রম দিয়ে যাচ্ছিল, অনেকটা যন্ত্রমানবের মতো কাজ করার যন্ত্র হয়ে উঠেছিল শ্রমিকরা। কষ্ট হলেও তারা মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারতো না”।
১৮৮৪ সালের অক্টোবরে আমেরিকার ‘ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস এন্ড লেবার ইউনিয়নস’ এর এক বৈঠকে ৮ ঘণ্টা কাজের সময় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরপর আমেরিকার বিভিন্ন লেবার ইউনিয়নের সম্মতিক্রমে ১৮৮৬ সালের মে মাসের ১ তারিখে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। দাবি ছিল একটাই, দৈনিক ৮ ঘন্টার বেশি কাজ আর নয়।
ধর্মঘটের বিপক্ষে মালিকপক্ষ আন্দোলনকে মোকাবেলা করতে পুলিশের সহযোগীতায় শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের গ্রেফতার করতে শুরু করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রমিকদের উপর নির্যাতন করতে থাকে। মালিকপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজের বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে প্রাণপণ লড়াই করে শ্রমিকরা। ১৮৮৬ সালের মে মাসের ১-৩ তারিখ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলমান ছিল।
এরপর শিকাগোয় বিক্ষোভরত শ্রমিকদের উপর চড়াও হয় পুলিশরা। শিকাগোর ম্যাককরমিক হারভেস্টিং মেশিন কোম্পানির সামনে পুলিশ গুলি চালায় শ্রমিকদের উপর। ঐ সময় শত শত শ্রমিক আহত হয়, নিহত হয় দুই জন। এই হতাহতের কারণে শ্রমিকরাও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এর পরের দিন হাজার হাজর শ্রমিকরা আন্দোলনের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে শিকাগোর ‘হে মার্কেট স্কয়ার’ এ সমাবেত হয়।
সেখানে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে চারজন শ্রমিক ও ৭ জন পুলিশ নিহত হয়। দাবি আদায় করতে আসা শত শত নিরস্ত্র শ্রমিক হতাহত হয়। পৃথিবীর শ্রমিক সংগ্রামের ইতিহাসে রক্তাক্ষরে এটি লেখা হয়ে থাকে ‘হে মার্কেট ম্যাসাকার’ নামে।
এই রক্তাক্ত ঘটনার পর মার্কিন সরকার শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। নৈরাজ্যবাদী হিসেবে ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গ্রেফতারের বিষয়টি বেশ সাড়া ফেলে। “হে মার্কেট ম্যাসাকার” এ যুক্ত থাকার অভিযুক্ত হওয়া ৮ জনের মধ্যে ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড আর একজনকে ১৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এরপর ১৮৮৯ সালের মে মাসের ১ তারিখকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ বলে ঘোষণা দেয় ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর ওয়ার্কার্স এন্ড সোসালিস্টস’। “হে মার্কেট ম্যাসাকার”কে শ্রমিক আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
যদিও আমেরিকার সরকার এই ঘটনার কোনো স্বীকৃতি দেয়নি এবং শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের দাবিকেও গুরুত্ব দেয়নি। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৬ সালে আমেরিকা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিকে আইনি স্বীকৃতি দেয়। ১৯১৭ সালে দ্বিতীয় নিকোলাসের পতনের ৪ দিন পর আমেরিকা সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে ‘দিনে ৮ কর্মঘণ্টা’র স্বীকৃতি দেয়।
১৯১৭ সালের পর থেকেই সোভিয়েত ক্ষমতাবলয়ে থাকা দেশগুলোতে মে মাসের ১ তারিখে “আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস” বেশ জাকজমকতার সঙ্গে পালন করা শুরু হয়।